কোয়ান্টাম কম্পিউটারঃ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বিনিয়োগের উত্তম খাত

 



বিগত ১০ বছরে "কম্পিউটার" ইন্ডাস্ট্রিতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। এছাড়াও এই ১০ বছরে কম্পিউটারের যেটুকু উন্নতি হয়েছে, কম্পিউটারের সম্পুর্ণ ইতিহাসে তা ঘটে নি। এছাড়াও কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে পূর্বের তুলনায় বহুগুণ!

কোয়ান্টাম কম্পিউটার


সমস্যা সমাধানের জন্য অনন্য এক যন্ত্র কম্পিউটার। কম্পিউটার সেই কাজটি করে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করার মাধ্যমে। কিন্তু এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ, কিছু সমস্যা রয়েগেছে যেগুলো জটিলতার কারণে সমাধান করা সম্ভব না। তাছাড়া সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহার করে তা সমাধান করা প্রায় অসম্ভব।

কেন অসম্ভব? প্রথমেই বুঝতে হবে কম্পিউটার তথ্য সংরক্ষণ করে কীভাবে। কম্পিউটারের তথ্য প্রসেসিং হয় "প্রসেসর" এ যা কোটি কোটি ট্রানজিস্টর দিয়ে তৈরি। এই ট্রানজিস্টরকে আমরা একটা সুইচের সাথে তুলনা করতে পারি। সুইচ অন করে এর মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে এটি 1 কে সংরক্ষিত করে। সুইচ অফ করার মাধ্যমে এটি 0 সংরক্ষিত করে রাখে।

আর এই 1 ও 0 এর এর লম্বা সারির মাধ্যমে কোনো লেটার বা নাম্বার বা কোনো ইনফরমেশন সেভ করা যায়। এই পদ্ধতিকে বাইনারি বলে। আর এই সারির প্রত্যেকটি 1 বা 0 কে বলা হয় "বাইনারি বিট"। অর্থাৎ বর্তমান ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটার বাইনারি পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে।

মানুষের চাহিদা অনুযায়ী এই প্রসেসর এর ক্ষমতা বাড়াতে হচ্ছে। এর জন্য প্রতি বছর প্রসেসরে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ ধারা বজায় রাখাও সম্ভব নয়। আর আরো উন্নত প্রসেসর তৈরি করতে এর মধ্যে আরো বেশি ট্রানজিস্টর দিতে হবে। এর জন্য ট্রানজিস্টরকে আরো ছোট করতে হবে। প্রসেসরকে আরো উন্নত করতে হলে এই ধারা বজায় রাখতে হবে।

এভাবে প্রতিনিয়ত ট্রানজিস্টর ছোট করতে করতে অ্যাটমিক পর্যায়ে চলে যাবে। আর তখন পূর্বের মত "অন", "অফ" করিয়ে তথ্য পরিচালনা করা যাবে না। ঠিক এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রয়োজন পড়বে "কোয়ান্টাম কম্পিউটিং"। অ্যাটমিক ট্রানজিস্টর জন্ম দেবে নতুন কম্পিউটার প্রযুক্তি "কোয়ান্টাম কম্পিউটিং" এর!

প্রচলিত কম্পিউটার "বাইনারি বিট" এর মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে "কোয়ান্টাম মেকানিকাল ফেনোমেনা" বা "কোয়ান্টাম যান্ত্রিক ঘটানা"র উপর ভিত্তি করে। আর কোয়ান্টাম কম্পিউটার এটা করবে "কোয়ান্টাম বিট" এর মাধ্যমে। এই বিশেষ বিটকে "কিউবিট"ও বলে।

কোয়ান্টাম বিট কী তা নিয়ে আলোচনা হবে। তবে তার আগে কোয়ান্টাম তত্ত্বের দুই-একটা বিষয় আলোচনা করব। বেশি তত্ত্ব টেনে এনে লেখাকে জটিল ও বড় করছি না।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে যাদের প্রাথমিক ধারণা আছেন তারাও জানেন যে কোনো সময় আলোকরশ্মি এমন আচরণ করে যে এটি কোনো "কণা"। আবার কোনো সময় এমন আচরণ করে যেন এটি " তরঙ্গ বা ওয়েভ"। আমাদের দৃশ্যমান ও পরিচিত জগতে এমনটা কখনো দেখা যায় না বা কখোনো কোনো কিছু এমন "ডুয়ালিটি" এর আচরণ করে না। যেমন আপনি কখনো দেখবেন না আপনার মোবাইল হঠাৎ চার্জার হয়ে গেছে। কিন্তু বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণার জগতে এটা স্বাভাবিক।

যাই হোক, কোয়ান্টাম তত্ত্বে এক চরম বিভ্রান্তিকর ও আলোচিত একটি উদাহরণ শ্রাডিঙ্গারের বিড়াল। কোয়ান্টাম তত্ত্বের এক অদ্ভুত বক্স যেখানে বিড়ালটি একই সাথে মৃত ও জীবিত! এই বিড়াল এত বড় পাবলিক ফিগার যে আশা করি যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তারা মোটামুটি জানেন। তাই বিস্তারিত এটা নিয়ে লিখছি না। আমাদের বিষয় "কোয়ান্টাম কম্পিউটার"। শ্রাডিঙ্গার সাহেবের বিড়ালের উদাহরণ মনে থাকলেই হবে, এখানে লিখার প্রয়োজন দেখছি না।

যাই হোক, শ্রাডিঙ্গার সাহেব এই উদাহরণ ও জটিল হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণার জগতে একটা কণা উনার বিড়ালের মত আচরণ করে। কণাটি একই সাথে দুইটি না ততোধিক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন দশায় থাকতে পারে।

পাঠক হয়তো ভাবছেন এটা কোয়ান্টাম বিট বা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাথে কীভাবে যুক্ত? হ্যা, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ফান্ডামেন্টাল হল " বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণার আচরণ"!

দেখুন অ্যাটমিক ট্রানজিস্টরে আমরা অন অফ করে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করতে পারব না একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর মধ্যে বিদ্যুৎ ইচ্ছামত থামিয়ে রাখা বা প্রবাহিত করানো যাবে না।

তখন এই অ্যাটমিক ট্রানজিস্টর শ্রাডিঙ্গারের বিড়ালের মত আচরণ করবে। ট্রানজিস্টর একই সাথে অন অফ অবস্থায় থাকবে!

একটি " বাইনারি বিট" শুধুমাত্র একটি 1 অথবা 0 সংরক্ষিত করতে পারে। আর "কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিট" সংরক্ষণ করতে পারে, "একই সময়ে 1 এবং 0"  অথবা "একটি 1" বা "একটি 0" বা "1 বা 0 এর মধ্যে অসীম নাম্বার"।

যদি ব্যপারটা জটিল লাগে প্রথম থেকে চিন্তা করুন। একটা ট্রানজিস্টরের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ যদি অন থাকে তাহলে তার মধ্যে 1 সংরক্ষিত থাকে। আর যদি বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করা হয় তাহলে 0 সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু যে জায়গায় একটা ট্রানজিস্টর একই সাথে " অন ও অফ"। অর্থাৎ সে একই সাথে 1 ও 0 সংরক্ষিত থাকবে। আবার শুধু 1 অথবা শুধু 0 সংরক্ষিত থাকবে। আবার 1 বা 0 এর মধ্যে অসীম নাম্বারও সংরক্ষিত থাকতে পারে। মূলকথা, এটি একই সময় একাধিক ভ্যালু স্টোর করে রাখতে পারবে, প্রসেস করতে পারবে।

1-0 এর  সহাবস্থান "কোয়ান্টাম কম্পিউটার" এর মূল শক্তি। একই সাথে 1 একই সাথে 0 এর প্রতিনিধিত্ব করার ফলে এটি একসঙ্গে বহু তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে।

ঠিক এই কারণে সাধারণ কম্পিউটার থেকে "কোয়ান্টাম কম্পিউটারের" ক্ষমতা বহুগুণ।

একই সাথে বহু তথ্যের সংরক্ষণ ও পরিচালনা করার ক্ষমতার কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের শক্তি সাধারণ কম্পিউটার থেকে বেশি।

কিন্তু আমাদের এটা ভাবা উচিত না যে "কোয়ান্টাম কম্পিউটার" যে কাজ করতে পারে, সাধারণ কম্পিউটার সেই কাজ করতে পারে না৷ কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাজ সাধারণ কম্পিউটার করতে পারবে, তবে এর জন্য বহু বহু গুন বেশি শক্তি, সময় লাগবে।

বাইনারি বা মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে কাজ করার ফলে সাধারণ কম্পিউটারের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। বড় বড় বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সমস্যা সমাধান মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ এর উপর ভিত্তি করে করা যায় না।

কিন্তু এই জায়গায় "কোয়ান্টাম বিট" ব্যবহার করে অনেক বড় বড় সমস্যা নিমিষেই সমাধান করা যাবে।

যে কাজ সাধারণ কম্পিউটার দিয়ে করতে কয়েকশ বছর লাগবে, হয়তো সেই কাজ কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে করতে কয়েক মিনিট লাগবে।

গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটার "সিকামা"


কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার আমাদের কীভাবে উপকারে আসবে?

প্রথম যে উপকার আমাদের হবে তা উপরে উল্লেখ করে দিয়েছি। সময় ও পাওয়ার বাচবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার একই সাথে বিভিন্ন প্রসেস চালাতে পারবে। অনেকটা মাল্টি টাস্কিং ও মাল্টি ফোকাস এর মত। এর জন্য একটা কাজ খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবে এই কম্পিউটার।

কোনো তথ্য আরো গভীর ও বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে আউটপুট দিতে সক্ষম হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এর ফলে কোনো ডিএনএ এর ম্যাপিং ও তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো রোগের প্রতিষেধক বের করা সম্ভব হবে। আমাদের আক্ষেপ আরো ৮-১০ বছর আগে গুগল বা অন্যান্য কোম্পানি "কোয়ান্টাম কম্পিউটারের" প্রজেক্ট হাতে নিলে হয়তো "কোভিড-১৯" এর একটা প্রতিষেধক পেয়ে যেতাম।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে ডেটা এনক্রিপশনের নতুন পদ্ধতি বের করা যাবে৷ ফলে ডেটা নিরাপত্তা আরো জোরদার করা যাবে।

তবে আশার বিষয় হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারকে কখনো রিপ্লেস করবে না। কারণ অনেক কাজ আছে যা কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে করা থেকে সাধারণ কম্পিউটার দিয়ে করা সুবিধাজনক হবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক ব্যয়বহুল।

প্রযুক্তির খুব নিদারুণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে এক তুমুল প্রতিযোগিতা লেগে গেছে টেক জায়ান্টগুলোর মধ্যে। গুগলের ঝুলিতে আছে ক্ষমতাধর "সিকোমা"। যা ৫৩ কিউবিটস এর প্রসেসর সম্পন্ন। এই প্রজেক্টে কাজ করা বিজ্ঞানীদের দাবি, " সিকোমা" একটি জটিল গানিতিক সমস্যার সমাধান করেছে। যা এখনকার সুপার কম্পিউটারগুলোর করতে প্রায় ১০০০০ এরও বেশি বছর লাগত। অবশ্য আইবিএম গুগলের এই দাবি মানছে না।

যুক্তরাষ্ট্র কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এ প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। টেক খাতে এগিয়ে চীনও থেমে নেয়। ৪০ কোটি ডলারের কোয়ান্টাম ল্যাব তৈরি করেছে তারা। বড় বড় বিজনেস ম্যাগনেটরা এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার এ বিনিয়োগের দিকে ঝুকছেন।

মাইক্রোসফট এর কোয়ান্টাম কম্পিউটার


এসব থেকে অনুমান করাই যাচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে "কোয়ান্টাম কম্পিউটার" এর হাত ধরে। অবশ্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর উপর ভিত্তি করেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হবে। "কোয়ান্টাম কম্পিউটার" আর "আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স" মিলে চমৎকার ও একইসাথে ভয়ংকর কিছু হওয়ার কথা!

সব উদ্ভাবনই মানুষের উপকারের জন্য করা। কিন্তু এর মাঝেও এগুলোর অপব্যবহার মানুষের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়ায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারও তার ব্যতিক্রম হবে না। এর অপব্যবহার মানুষের জন্য বয়ে আনতে পারে চরম দুর্ভোগ। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং মানবজাতির জন্য উদ্বেগজনক হবে কী হবে না তা নির্ভর করছে এটি কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর।

চায়নার কোয়ান্টাম ল্যাব


তথ্যসূত্রঃ
১.আইবিএম (https://www.ibm.com/quantum-computing/what-is-quantum-computing/)

২. সাইন্স এলার্ট (https://www.google.com/amp/s/www.sciencealert.com/quantum-computers/amp)

৩.ন্যাচার সাময়িকী (https://www.nature.com/articles/d41586-020-03237-w)

৪. এনালিটিক্স ইনসাইট
(https://www.analyticsinsight.net/top-10-countries-leading-quantum-computing-technology/)

৫.গুগল রিসার্চ (https://research.google/teams/applied-science/quantum/)

৬.লাইভসাইন্স(https://www.google.com/amp/s/www.livescience.com/amp/google-hits-quantum-supremacy.html)

Post a Comment

1 Comments

  1. সমাজ থেকে লুকিয়ে ইন্টারনেট জগৎে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি ।

    ReplyDelete