ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট(আইসি) ও সকল প্রজন্মের কম্পিউটার নিয়ে কিছু কথা

বিশ্বের সর্বপ্রথম আইসি


কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রিতে রেভ্যুলেশন আনতে আইবিএম, স্টিভ জবস, মাইক্রোসফট, চার্লস ব্যবেজ, কবি বায়রনের মেয়ে এডা লাভলেস যতটা ভূমিকা রেখেছেন, তার থেকে বেশি ভূমিকা রেখেছেন "জ্যাক কিলবি"। ১৯৫৮ সালে তার ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের আবিষ্কার কম্পিউটারের দুনিয়ায় যে পরিবর্তন এনেছিল, তার ফলাফল আজকের হাই পারফরম্যান্স কম্পিউটারগুলো! ১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবি বড় সার্কিট ক্ষুদ্র করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তবে একই সময় রবার্ট নয়েসও বড় সার্কিট ক্ষুদ্র করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। 


আইসি এর ব্যপারে একটু পরে আসছি। আগে কম্পিউটারের কিছু ফান্ডামেন্টাল বিষয় আলোচনা করি। 


একটা কম্পিউটারের ফান্ডামেন্টাল ইলেক্ট্রনিক কম্পোনেন্ট হলো, ট্রানজিস্টর, ডায়োড, রেজিস্টার, ক্যাপাসিটর ইত্যাদি।

প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হতো। যার ফলে ঐ কম্পিউটারগুলো অনেক বড় হতো৷ কয়েকটা ঘরে এসব কম্পিউটার রেখে মেইনটেইন করতে হতো। যার ফলে এসব কম্পিউটারের খরচ ছিল বেশি৷ কর্পোরেট ছাড়া সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার। 


১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবি আর রবার্ট নয়েস ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আবিষ্কারের আগে আরেকটি বিপ্লব ঘটে৷ ১৯৪৮ সালে বেল ল্যাবরেটরিতে উইলিয়াম বি. শকলি, জন বার্ডিন, এবং এইচ ব্রিটেন সম্মিলিতভাবে "ট্রানজিস্টর" তৈরি করেন৷ এই ট্রানজিস্টর এখন সব ধরনের কম্পিউটারেই ফান্ডামেন্টাল ইলেক্ট্রনিক কম্পোনেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ ১৯৪৮ সালের ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের ফলে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের তুলনায় ছোট কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব হয়৷ আমরা প্রবেশ করি দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের যুগে৷ 

স্যার উইলিয়াম শকলি



তবে এটা কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রির আসল বিপ্লব ছিল না। তবে ট্রানজিস্টর এর আবিষ্কার কম্পিউটার এর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ কারণ সকল কম্পিউটারই ট্রানজিস্টরের মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখছি না, তবে আমার আরেকটি আর্টিকেলে ট্রানজিস্টর নিয়ে হালকা পাতলা আলোচনা করেছি। পড়ে নিতে পারেন এখান[১] থেকে। 


যাই হোক, ট্রানজিস্টর তৈরির মূলনীতি, ও উপদান ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা অন্যান্য ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট ছোট করতে সক্ষম হয়। যার ফলে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারে ব্যবহার করা বর্তনী থেকে আরও ছোট আকারের বর্তনী তৈরি করা সম্ভব হয়। 


তবে তখনও সার্কিটগুলো সেরকমভাবে ছোট ছিল। ছোট করার উদ্যোগ নেন জ্যাক কিলবি ও রবার্ট নয়েস, ১৯৫৮ সালে। তবে তারা আলাদাভাবে এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। 



স্যার জ্যাক কিলবি


তারা একই উপাদানের যন্ত্রাংশের উপর অ্যালুমিনাম বা তামার তৈরি সরু ধাতব পথ বসিয়ে দেন। এই ধাতব পথ তারের মতো কাজ করে। যেহেতু একটি যন্ত্রাংশের মধ্যে সরু ধাতব পথ, আর যেহেতু এই পথ তার হিসেবে কাজ করবে, তাই তারা সকল ইলেক্ট্রনিক কম্পোনেন্ট একটা কঠিন উপাদানের ঠুকরোর মধ্যে বসাতে সক্ষম হোন। অর্থাৎ তারা একটি সম্পূর্ণ বর্তনীর সকল কম্পোনেন্ট একটি উপাদানের খন্ডের উপর সমন্বিত করেন। 


জ্যাক কিলবি প্রথম আইসি তৈরি করতে সক্ষম হোন। ১৯৫৯ সালে জ্যাক কিলবি তার এই আবিষ্কার প্যাটেন্ট করেন ও দুনিয়ার সামনে তুলের ধরেন৷ তখনই ইউএস এয়ার ফোর্স সর্বপ্রথম ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট কিনে। ২০০ সালে কিলবি তার আবিষ্কারের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। 


জ্যাক কিলবির আইসিতে অ্যালুমিনিয়াম বা তামা ব্যবহারের কারণে এক্সটার্নাল ওয়্যারিং এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এই সমস্যার কারণে জ্যাক কিলবির আইসি ম্যাস প্রোডাকশনে ব্যহত হয়েছিল। 


যাই হোক, এই সমস্যার সমাধান একই বছর জ্যাক কিলবি আর রবার্ট নয়েস মিলে সমাধান করেন। রবার্ট নয়েস অ্যালুমিনিয়াম বা তামার পরিবর্তে সিলিকন ব্যবহার করার প্রস্তাব দেন। নয়েসের এই আইসি কে মনোলোথিক আইসি বলা হয়। মনোলোথিক আইসিতে সিলিকনের চিপের উপর সম্পূর্ণ বর্তনীর ইলেক্ট্রনিক কম্পোনেন্ট সমন্বিত করা হয় ও কপারের ধাতব পথ দিয়ে সব কম্পোনেন্টের সংযোগ দেওয়া হয়। 


১৯৬১-১৯৬৫ সালের মধ্যে নাসার অ্যাপোলো প্রোগ্রাম ছিল এই আইসির সর্ববৃহৎ কাস্টমার(সূত্র উইকিপিডিয়া)। 


এক সেন্টিমিটার এর কম সাইজের সমন্বিত বর্তনীতে কয়েক কোটি ট্রানজিস্টর জুড়ে দেওয়া সম্ভব হয়। আমরা এখনকার যে প্রসেসরগুলো ব্যবহার করি, তাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ট্রানজিস্টর রয়েছে। অথচ প্রসেসরের সাইজ দেখে বিশ্বাসই হয় না এর মধ্যে এত ট্রানজিস্টর থাকতে পারে৷ 


যাই হোক, আইসি ব্যবহারের ফলে কম্পিউটারের আকার ছোট হতে শুরু করে৷ প্রতিবছর আইসির নতুন নতুন সংস্করণ আবিষ্কৃত করা হয়, প্রতিবছর কম্পিউটারের আকার কমতে থাকে। শুধু তাই না, এসব কম্পিউটারের ক্ষমতা বহূ গুণ বেড়ে যায়। 


বের হতে থাকে দ্বিতীয় প্রজন্ম, তৃতীয় প্রজন্ম, চতুর্থ প্রজন্ম, এখন পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার। কম্পিউটার চলে আসে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে।


 দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার থেকেই শুরু হয় উচ্চস্তরের মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে কম্পিউটার প্রোগ্রাম করা। তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার থেকে শুরু হয় অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহার। এর ফলে কম্পিউটারে তথ্য সংগ্রহ ও পরিচালনা করা সাধারণ মানুষের জন্য সহজ হয়ে যায়। তখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারে পুরোদমে শুরু হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি এর ব্যবহার। তাছাড়া ততদিনে ট্রানজিস্টরে অপটিকাল ফাইবার ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে কম্পিউটারগুকো অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠে। 

পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারে আমরা আশা করতে পারি আরো অধিক অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন প্রসেসর ব্যবহার করা হবে। 


একবার চিন্তা করেন। ১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবির আইসি আবিষ্কারের আগে, সামান্য "স্টোরেজ" সেটাপ করার জন্য একটা আস্ত রুম লাগত৷ জাস্ট চিন্তা করেন, আমরা এখন কম্পিউটার গুলোতে যে কম্পোনেন্টগুলো ব্যবহার করি, ঐ সময় একেকটি কম্পোনেন্ট একেকটি রুমে রাখতে হতো!


ভ্যাগ্যিস জ্যাক কিলবি, উলিয়াম শকলি, রবার্ট নয়েসের মতো মানুষ আমরা পেয়েছি। নাহলে চার্লস ব্যাবেজ, কবি বায়রনের কন্যা এডা লাভলেস, তাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত৷ আমরা চতুর্থ প্রজন্মের মতো উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার পেতাম না৷ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি নিয়ে কাজ করতে পারতাম না৷ ইভেন আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটারও[2] জ্যাক কিলবির আবিষ্কারের ফলাফল! 


[1] 

[2] 

তথ্যসূত্রঃ ১. https://www.britannica.com/technology/integrated-circuit

২. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Integrated_circuit





Post a Comment

0 Comments