কোভিড-১৯ |
কভিড-১৯ পরিস্থিতি মাত্র এক বছরে আমাদের যা কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা কিছু দেখিয়ে দিয়েছে, তা অন্য কোনো পরিস্থিতি আমাদের দেখাতে পারে নি।
সমাজের কিছু ফাক-ফোকড়, ব্যর্থতা, গুরুতর সমস্যা আমাদের অগোচরে ছিল।
২০২০, এই একটা বছর দেশের মানুষ কী করে যে সারভাইভ করেছে শুধু আমরাই জানি।
বাংলাদেশ কোনো উন্নত দেশ না। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল(!) একটি দেশ। একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য মহামারী খুবই মারাত্মক জিনিস।
এই মহামারী প্রথম দিকে আমরা অনেক ভয়ে ছিলাম। ভয় সবথেকে বেশি ছিল অর্থনীতি নিয়ে। ভেবেছিলাম হয়তো অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে। পড়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। তেলের দাম ঋণাত্মক হয়ে গেছিল।
এরকম একটা পরিস্থিতি একটা উন্নয়নশীল দেশ খুবই মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে এটা স্বাভাবিক। এর মধ্যে দেশে আগে থেকেই যদি প্রতিবন্ধকতা থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই।
মহামারীর প্রথম দিকে সবকিছু ভালোই চলছিল। আমরা একে অপরের সাহায্য করার যে নজির স্থাপন করেছি, তা এককথায় অতুলনীয়।
কিন্তু কোনো সভ্যতাই একদম পারফেক্ট না।
বাংলাদেশের সবথেকে বড় যে সমস্যা, সেটা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু না। সব সরকারের আমলেই অনেক বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে।
কিন্তু মানুষের আয়-রোজগার নেই, সবাই আতংকিত, দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি ইত্যাদি পরিস্থিতি দুর্নীতি আশা করা যায় না।
বিশেষ করে এরকম পরিস্থিতি সরকারের স্বাস্থ্য খাত যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়, তাহলে দেশের জন্য অনেক বড় সমস্যা। বেশ কিছু দুর্নীতির চিত্র আমাদের সামনে এসেছিল। যেমনঃ মেডিকেল ইকুইপমেন্ট অত্যাধিক মূল্যে কেনা, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে অবহেলা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডাইভারের অবৈধ সম্পদের পাহাড় ইত্যাদি।
এছাড়াও এই পরিস্থিতিতে সরকার দুস্থদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করেছিল। আমরা চোখ বন্ধ করেই বলতে পারি সর্বোচ্চ ৩০% মানুষ সঠিকভাবে ত্রাণ পেয়েছিলেন।
করোনা পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দুর্নীতি দমন না করতে পারলে দেশ কখনোই এগুতে পারবে না।
শুধু বাংলাদেশ না, এটা যেকোনো উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের স্বাভাবিক সত্য।
করোনা মহামারীতে যে জিনিস আমাদের সবথেকে ক্ষতি করেছে তা হলো ধর্মান্ধতা, ধর্ম ব্যবসা, নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করা ইত্যাদি।
যখন প্রথম চায়নায় করোনা শনাক্ত করা হয়, দেশের সব হুজুর একযোগে ঘোষণা দিলেন এটা চায়নাবাসির জন্য আল্লাহর গজব।
করোনা ছড়াতে ছড়াতে যখন প্রথম বাংলাদেশে শনাক্ত হলো, আবার সব হুযুর একযোগে ঘোষণা দিলেন এটা নাফরমান, নাস্তিক-মুরতাদের জন্য আল্লাহর শাস্তি। যখন দেখা গেল কিছু ইসলামিক স্কলার করোনায় আক্রান্ত হলেন, এটা ছিল আল্লাহর পরিক্ষা!
হিন্দু ধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর স্কলাররাও এই রকমের হিপোক্রেসি থেকে বিরত ছিলেন না। ৯০% মুসলমানদের দেশ হিসেবে শুধু ইসলামিক স্কলারদের কথাগুলোই আমাদের সামনে এসেছে।
কিন্তু ইন্ডিয়াতে আমরা দেখেছি হিন্দু ধর্মের স্কলাররা একটা সেন্সেটিভ পরিস্থিতি কী করেছেন।
হিপোক্রেসির একটা লিমিট থাকে। ধর্ম নিয়ে হুজুররা যে হিপোক্রেসি দেখালেন, সাধারণ মানুষও অবাধে সেই হিপোক্রেসি গিলে ফেলল।
আপনি বিশ্বাস করবেন না, এখনো, মানে করোনা পরিস্থিতির দুই বছর পরেও আমাদের গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে করোনা বলতে কিছুই নেই! তারা এখনো বিশ্বাস করে করোনা আমাদের মানে মুসলমানদের হবে না।
এখন বুঝেন মানুষ কীভাবে সচেতন হবে?
আমরা তো কঠোর লকডাউন মানতে পারব না। আমাদের পেটের দায়ে বেড় হতে হবে৷ কিন্তু যার যার অবস্থান থেকে সচেতন থাকলে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হতো।
করোনা মহামারী ঘিরে বেশ কিছু কন্সপাইরেসি থিওরি বের হলো। এগুলো বিশেষ করে হুজুররা জুম্মার খুতবায় বলতেন। সরকার নাকি ইসলাম ধ্বংস করতে করোনা ভাইরাসের নাটক সাজিয়েছে। মানুষকে মসজিদে যাওয়া বন্ধ করাতে এসব নাটক।
একজন হুজুর তো নাকি স্বপ্নে করোনার ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের সুত্রও পেয়েছিলেন।
তাছাড়া যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সবথেকে সেন্সেটিভ জায়গা হলো ধর্ম। মানুষকে ধর্মের দ্বারা আবেগিত করলে সবকিছুই সম্ভব।
এছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ছিল একটি বড় সমস্যা।
দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল একটা পরিবেশ ছিল। এরমাঝে শনাক্ত হলো করোনা ভাইরাস।
বিরোধীদল চরমভাবে এর ফায়দা উঠিয়েছে। ক্ষমতাসীন পার্টিও কম ছিল না।
এর দায়ভার দিতে হবে তৃণমূল ও মহানগর পর্যায়ের দলীয় নেতাদের।
২০২১ সালে বেশ কয়েকটি ভ্যাক্সিন যখন বের হলো, দেশে শুরু হলো নতুন এক কন্সপাইরেসি থিওরির অধ্যায়।
ভ্যাক্সিন নিয়ে অনেক অসাধু মানুষ ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করেছেন। আঘাতটা ছিল যেহেতু ধর্ম নিয়ে, মানুষ সেটা সহজভাবেই গ্রহণ করেছে।
ভ্যাক্সিন নিলে ধর্ম থাকবে না, ভ্যাক্সিনে বিল গেটস মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, ভ্যাক্সিন শুধু মাত্রই পানি ইত্যাদি।
অথচ জাস্ট কমনসেন্স দিয়ে চিন্তা করলেও দেখা যাবে এগুলো জাস্ট ফাউল থিওরি।
মহামারীর সময় সবথেকে ভয়াবহ যে সমস্যা আমরা ফেস করেছি, তা হলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি।
মানুষের আয় রোজগার নাই। বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে।
এদিকে ভাগ্যক্রমে এই বছর বন্যা হয়নি। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ ছিল।
কিন্তু তবুও প্রতিটি বাজার ছিল আগুন। তেল থেকে শুরু করে আলু পেয়াজ সবকিছুর দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
সিন্ডিকেট এর মাধ্যমে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই কান্ডটা ঘটিয়েছিল। যার ফলাফল আমরা এখনো ভুগছি। করোনা ভাইরাদের দুই বছর হয়ে গেল, বাজার এখনো স্বাভাবিক হয় নি।
শিক্ষা ব্যবস্থা তো বলতে গেলে ভেঙ্গেই গেছে। সবকিছু খোলা, কোর্ট, সরকারি অফিস সবকিছুই খোলা। কিন্তু স্কুল বন্ধ। এর কোনো মানে হয়?
ভ্যাক্সিন নিয়ে দুর্নীতি এখনো চলছে। যে জায়গায় অন্যান্য দেশ ৭০% ভ্যাক্সিনেটেড, সেখানে বাংলাদেশে আপনার আত্মীয় কেউ রাজনীতি বা সরকারি অফিসার না হলে ভ্যাক্সিন পাবেন না।
ভ্যাক্সিনেশন প্রক্রিয়া খুবই ধীরগতিতে হচ্ছে। এখনো অনেক মানুষ ভ্যাক্সিন পায়নি। আর কিছু মানুষ এখনো ভ্যাক্সিন নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করছেন।
বেশকিছুদিন ধরে করোনা মহামারী বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মৃত্যু ও আক্রান্তদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। এই জায়গায়ই অনেক দুর্নীতি, অনেক ব্যর্থতা আমারা দেখতে পাব।
কিছুদিন আগে নিউজ দেখলাম করোনা আক্রান্ত বাবার জন্য অক্সিজেন নিয়ে আসছিলেন ছেলে। পুলিশ রাস্তায় আটকিয়ে রাখলেন। এদিকে বাবা অক্সিজেনের অভাবে মারা গেলেন।
আমরা কয়জন এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছি?
এদিকে লকডাউন নিয়েও চলছে হাসি তামাশা। এই লকডাইন, এই সীমিত আকারে লকডাউন, আবার কখনো লকডাউন স্থগিত। যেন লকডাউন কোনো খেলা।
২০২০ সালের আগেই আমি আমার দেশ নিয়ে অনেক সন্তুষ্ট ছিলাম। যা কিছুই হোক, দেশ তো ভুলতে পারি না। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আমার এই ধারণা পালটে দিয়েছে। এখন আমার মনে হয় এই দেশে জন্ম নিয়ে সবথেকে বড় ভূল করেছি।
আসলে আমাদের ব্যর্থতা ঢাকার কিছুই নেই। এখনো সময় আছে আমরা সবকিছু ঠিক করে দিতে পারি।
কিন্তু কখন যে দেশের মানুষ ও দেশের সিস্টেমের সুবুদ্ধি আসবে তা বলা মুশকিল।
পরিবর্তন অবশ্যই আসে। এক রাতেই আমরা পরিবর্তন আশা করতে পারি না। হয়তো ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হবে। আমরা ফিরে যেতে পারি আমাদের আগের জীবনে। এখন পৃথিবী যেরকমই হোক, সেটা তো আমাদেরই হাতে। এসব ছোট ছোট আশা নিয়ে আমরা বাচতে পারি।
আশাকরি পৃথিবী আবার করোনা-মুক্ত হবে। আমরা সবাই মাস্ক খুলে বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারব। জয় হোক মানবের, জয় হোক মানবতার।
0 Comments