বিশ্বে কম্পিউটার চিপ এর সংকট: এর কারণ ও অর্থনীতিতে প্রভাব

বিশ্বের বাজারে সেমিকন্ডাক্টর চিপ এর সংকট 



সেই ২০২০ সাল থেকে শুরু হয়েছে কম্পিউটার চিপ এর সংকট। এই সেমিকন্ডাক্টর চিপ কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি, গ্রাফিকস কার্ড ইন্ডাস্ট্রি সহ কোন ইন্ডাস্ট্রিতে না ব্যবহার করা হয়? সেমিকন্ডাক্টর চিপ এর চলমান সংকটের কারণে অনেক এসব ইন্ডাস্ট্রির বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। 

শুধুমাত্র ২০২১ সালে বিশ্বের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি ২১০ বিলিয়ন ডলার এর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে[1]। ভোগান্তিতে আছে গ্রাহকেরাও। আমেরিকান, জার্মানসহ বিশ্বের প্রায় সকল কার কোম্পানির প্রোডাকশন মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। বেশ কয়েকটি মার্কেট লিডার কোম্পানি কিছু কিছু কারের প্রোডাকশন কমাতে বাধ্য হচ্ছে। যার মধ্যে আছে ফোর্ড, টোয়েটো, জেনারেল মোটরস, ওপেল ইত্যাদি[2]। এমনকি Opel তাদের জার্মানির ফ্যাক্টরি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে[3]। দাম বাড়ছে গ্রাফিকস কার্ড সহ বেশ কিছু ইলেকট্রনিকস এর। 
ইউস এর ভেতর কার প্রোডাকশন এর FRED এর ডাটা



উপরের ছবিতে FEDR এর পরিসংখ্যান এ দেখতে পারছেন প্যানডেমিক সিচুয়েশনের কারণে ২০২০ সালে প্রোডাকশন 0 তে নেমে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে প্রোডাকশন যখন বাড়তে শুরু করল, চিপ সংকট এর কারণে সেই গ্রাফটাও আবার নিচে নামতে শুরু করে। 

কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর চিপ এর এত আকাল কেন? এর কারণ কী? 
চিপের সংকটের প্রধান কারণ হলো কোভিড-১৯। কোভিড পরিস্থিতির কারণে শুধু চিপ ইন্ডাস্ট্রি না, প্রায় সকল ইন্ডাস্ট্রিই ক্ষতির মুখে পড়েছিল। লকডাউন এর কারণে সাপ্লাই চেইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। 

একেতো সাপ্লাই চেইন নাই। প্রোডাকশন লসে চলছে। অপরদিকে "ওয়ার্ক ফ্রম হোম" এবং "রিমোট জব" বৃদ্ধি পাওয়ায় কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ও ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ব্যবহার করা হয় এমন ইলেকট্রনিকস এর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল[4]। এর ফলে মার্কেটে "সাপ্লাই কম, ডিমান্ড বেশি" টাইপের এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। 

দ্বিতীয় কারণ চায়না-আমেরিকা ট্রেড ওয়ার। চায়না বিশ্বের সর্ববৃহৎ চিপ উৎপাদনকারি দেশের মধ্যে অন্যতম। চায়না-আমেরিকা বাণিজ্য দ্বন্দ্বে আমেরিকা চীনের সবচেয়ে বড় চিপ ম্যানুফ্যাকচারার Semiconductor Manufacturing International Corporation (SMIC) এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে[5]। এর ফলে তারা আমেরিকান কোম্পানিগুলোর কাছে আর চিপ বিক্রি করতে পারবে না। আমেরিকান কোম্পানির শেষ ভরসা তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারক কোম্পানি ও স্যামসাং এর মত কোম্পানি। তারা অবশ্য আগেও চিপ উৎপাদন করত। কিন্তু SMIC এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় চিপ এর যে বিপুল পরিমাণ চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা স্যামসাং বা IBM বা TSMC কোম্পানিগুলোর পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভব না৷ 

তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর চিপ ইন্ডাস্ট্রির মার্কেট লিডার, প্রোডাকশন বাড়িয়ে তারা কিছুটা হলেও সাপ্লাই বাড়াতে পারত। কিন্তু কথায় আছে সময় যখন খারাপ যায়, সবদিক দিয়েই খারাপ যায়। ২০২১ সালে তাইওয়ান এ দেখা দেয় শতাব্দীর সবথেকে ভয়াবহ খরা৷ সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদনে ও প্রস্তুতকারী ফ্যাক্টরিতে বিপুল পরিমাণ বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়। ফলে সে বছর তাইওয়ানও চাহিদা অনুযায়ী চিপ প্রস্তুত করতে পারে নি[6]। 


এছাড়াও গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কারণে অস্টিন ও টেক্সাসে অবস্থিত স্যামসাং ও NCP Semiconductors এর মত কোম্পানির কারখানা কয়েক মাস বন্ধ রাখতে হয়েছিল। 

পরিস্থিতি অনেকটা আগুনের মতো পেট্রোল ঢেলে দেওয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল। ২০২০ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বড় বড় সেমিকন্ডাক্টরে চিপ ম্যানুফ্যাকচারার ও ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট এ ব্যবহার করা হয় এমন ইলেকট্রনিকস কম্পোনেন্টস উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে৷ 

সব মিলিয়ে ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়টা সেমিকন্ডাক্টরে চিপ ম্যানুফ্যাকচারারদের জন্য খুবই খারাপ একটা সময়। 

তবে সরকার ও টেক কোম্পানিগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য। এখন পর্যন্ত তিন দফায় হোয়াইট হাউসের সাথে মিটিং এ বসেছেন আমেরিকার বেশ কয়েকটি টেক কোম্পানি সহ বাইরের বেশ কয়েকটি কোম্পানির সিইওরা। হোয়াইট হাউস এসব সিইওদের কাছ থেকে চলমান পরিস্থিতির সব তথ্য চেয়েছে ও এবং সমস্যা সমাধানের জন্য একসাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়াও মার্কেট লিডাররা প্রোডাকশন বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। 

IBM ও INTEl এর সিইওরা প্রেডিকশন করছেন চিপের এই চলমান সংকট আরও দুই বছর স্থায়ী হতে পারে। Northwestern University এর কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রফেসর Seda Memik বিবিসির দেওয়া একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, "পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকবছর লেগে যেতে পারে। চিপস এর চাহিদা এত দ্রুতগতিতে বাড়ছিল যে এর সংকট অনিবার্য ছিল" [7]

আশা করা যাচ্ছে ২০২২ এর ব্ল্যাক ফ্রাইডের আগেই ক্রাইসিসটা শেষ হবে। এর মধ্যে অবশ্য করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট "ওমিক্রন" এর কারণে সামনের পরিস্থিতি প্রেডিক্ট করা যাচ্ছে না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে "ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট" মার্কেটে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। 

তথ্যসুত্রঃ 

2. BBC

3. Reuters 

4. Fortune 



Post a Comment

0 Comments